শিশুযোদ্ধার সমারোহ

হোম

দক্ষিণ সুদানের তেলসমৃদ্ধ ইউনিটি প্রদেশের রাজধানী বেনটিউয়ের কাছাকাছি রাবখোনা নামক স্থানের একটি বাজার। কিছুদিন আগেও জায়গাটি গমগম করত। আর এখন পরিত্যক্ত। তারপরেও উর্দি পরিহিতরা মেশিনগান নিয়ে জায়গাটি পাহারা দিচ্ছে। অবশ্য পাহারা দেওয়ার তেমন কিছুই নেই। সব দোকানই ভাঙাচোরা এবং ফাঁকা। স্থানীয় লোকজন সব লুট করে নিয়ে গেছে। রাবখোনা শহরের এ বাজারটি জাতীয় সেনাবাহিনী এসপিএলএ’র নিয়ন্ত্রণে। অলসভাবে বসে থাকা সেনাসদস্যদের অনেকেই শিশু। এদেরই একজন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। চোখ লাল। সিগারেট চাচ্ছিল সে। সম্প্রতি তার পদোন্নতিও হয়েছে। সাধারণ সৈনিক থেকে বনে গেছে একজন কমান্ডারের সশস্ত্র দেহরক্ষী। এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই, ‘এখানেই শেষ নয়, আমি আরও অনেক উপরে উঠব।’

এসপিএলএ এই মুহূর্তে ব্যস্ত নয়; কিন্তু তারা খবর পেয়েছে বিদ্রোহীরা সহসাই বেনটিউয়ে আক্রমণ চালাতে পারে। পৃথিবীর কনিষ্ঠতম রাষ্ট্রটিতে গত ডিসেম্বরে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বেনটিউ হাতবদল হয়েছে কয়েকবার। তেলসমৃদ্ধ বলে উভয় পক্ষই এ শহরটিকে দখলে রাখতে চায়। দক্ষিণ সুদান সরকারের রাজস্বের ৯৮ শতাংশই আসে এখানকার তেল ক্ষেত্র থেকে। যে কারণে তেলের দিকেই সবার চোখ। নবীনতম রাষ্ট্রটিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছে ৪৬ হাজার শরণার্থী। তবে দেশব্যাপী বাস্তুচ্যুত লোকের মোট সংখ্যাটা ১.৫ মিলিয়ন।

ইউনিসেফ-এর তথ্যানুসারে, উভয় পক্ষই যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার করছে। প্রেসিডেন্ট সালভা কীর এবং উপপ্রধানমন্ত্রী থেকে বিদ্রোহী নেতা বনে যাওয়া রিক মাচারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শিশুরা বড়ে’তে পরিণত হয়েছে। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে সরকার তৃতীয়বারের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, নিয়োগ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা এবং সেনাবাহিনীতে শিশুদের ব্যবহারের সমাপ্তি টানার জাতিসংঘের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। এসপিএলএ মুখপাত্র ফিলিপ আগুয়ের ফোনে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, ‘সেনাবাহিনীতে শিশুসৈন্য থাকতে পারে; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সেটি যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।’ একই সুরে কথা বলেছেন মাচারের মুখপাত্র মাবিওর গারাং মাবিওরও, ‘শিশুসৈন্য নিয়োগ দেওয়ার নীতি আমাদের নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।’

ওই শিশুদের একজন জেমস সময় কাটাচ্ছিল রাবখোনা বাজারে। বয়স বারোর আশেপাশে। লম্বায় হাতের রাইফেলটার চেয়ে একটু বড়। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে এগিয়ে আসেন এক সেনা কর্মকর্তা। ঐ শিশুর পরিহিত ইউনিফর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিলেন ঐ সেনা কর্মকর্তা, ‘যদি সে ইউনিফর্ম না পরে, ওরা তাকে আহত করবে অথবা মেরে ফেলবে। তার রক্ষার জন্যই এই ইউনিফর্ম।’ তবে এই ওরা কারা, সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি তিনি। ১৩ বছর বয়সী সিমনের ব্যাপারেও একই কথা জানান সেনা কর্মকর্তা। তার দাবি, কোনো শিশুকে জোর করে দলে টানা হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় আসছে তারা। এমনকি অনেকে দলে নেয়ার জন্য কান্নাকাটি পর্যন্ত করে।

রাবখোনা বাজার থেকে দশ মিনিট দূরের (গাড়িতে) এক জায়গায় একটি জাতিসংঘের ক্যাম্পের মধ্যে শরণার্থীর মতো বসবাস করছে সাবেক শহুরে বাসিন্দারা। এখানেই চা বিক্রি করেন ৪৮ বছর বয়স্কা মারিয়া। পাঁচ সন্তানের এ জননী শোনান তার ১৩ বছর বয়সী ছেলের কাহিনি। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর প্রায় চার মাস তার কোনো হদিস ছিল না। মারিয়া পরবর্তীতে তার দোকানের এক খদ্দেরের মারফত খবর পান, সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। অথচ সে খুব ভালো ছাত্র ছিল। খবরটা শোনার পরই ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলেন মারিয়া। ইচ্ছে ছিল বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত আনার। কিন্তু সামরিক প্রশিক্ষণ চলছে বিধায় তার কাছে যাওয়ারই সুযোগ হয়নি। দূর থেকে দেখেছিলেন, ছেলে অস্ত্র হাতে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে; কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। এর এক মাস পরই বেনটিউয়ের যুদ্ধে গুলি খেয়েছিল মারিয়ার ছেলে। এ সময় কয়েক দিনের জন্য মায়ের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তাকে। থেকে যেতে বলার পর তার উত্তর ছিল, ‘অফিসাররা আমাকে ভালো খাবার ও অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্যাম্পের জীবনের চেয়ে ওখানকার জীবন অনেক ভালো।’

ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা ৩৪ বছর বয়স্কা সারার গল্পটাও প্রায় একই রকমের। তার পনেরো বছর বয়সী ছেলে এক সেনা কর্মকর্তার প্ররোচনায় তাদের দলে ভিড়েছে এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে চায় না। এ ব্যাপারে ছেলের জবাব, ‘ক্যাম্পে খাবারের কষ্ট; লোকজন মরছে। তাহলে কেন আমি ফিরে যাব।’ সারা এক অফিসারের কাছে ছেলেকে ভিক্ষা চেয়েও পাননি। উল্টো সইতে হয়েছিল তিরস্কার, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা কাউকে জোর করি না। সে চাইলেই ফেরত যেতে পারে। আপনি এ ব্যাপারে ফের আমাকে বিরক্ত করলে পরিণতি খারাপ হবে।’

বিদ্রোহীরাও কম যাচ্ছে না। তাদের শিবিরেও রয়েছে অনেক শিশুসৈন্য। গত ডিসেম্বরে বিদ্রোহীরা প্রথমবারের মতো বেনটিউ দখল নেওয়ার দিনে অঙ্ক ক্লাসে ছিল ম্যাথিউ। একদল সশস্ত্র লোক স্কুলের সকলকে ডেকে বলেছিল, এ স্কুলের তিনশ’ ছাত্রকে তাদের চাই। সরকারি সৈন্যরা রাজধানী জুভায় নুয়ের এথনিক গ্রুপের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করছে; এর প্রতিশোধ নিতে হবে। বিদ্রোহী নেতা মারচার একজন নুয়ের। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট কীর এসেছেন দেশের সর্ববৃহত্ এথনিক গ্রুপ দিনকা থেকে। ম্যাথিউ প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তীতে রাজী হয়েছিল, কেননা তাকে এবং তার পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

কমান্ডাররা এক রাতে ছেলেদের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আনতে পাঠানোর পর পালিয়ে আসে ম্যাথিউ। সেই থেকে সে ক্যাম্পেই আছে; ভুলেও ক্যাম্পের বাইরে যায় না। তার মধ্যে সবসময় আতঙ্ক কাজ করে— কখন না আবার ধরে নিয়ে যায়।